জোঁক এমন এক প্রানি একবার দেখলে সারা জীবন মনে থাকে।জোঁক নাম নিলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে যেন।এদের কেঁচোর মতন ক্লাইটেলাম আছে ও গমনাঙ্গ সিটে।
![]() |
জোঁক কামড়ালে ক্ষতি নয় উপকার হয় |
বাংলাদেশের ভাষায় এগুলোকে "খেউরা জোঁক" বা " চীনা জোঁক" বলে থাকে। স্যাঁতসেতে ভিজামাটি জোঁকের পছন্দনীয় বাসস্থান।এরা প্রানীর ত্বকে ছিদ্র করে রক্ত শুষে।তবে এরা যেটুকু রক্ত খায় তাতে প্রানীর কোন সমস্যা হয়না। কিন্তু রক্ত খেতে যে ছিদ্রটি করে, সেই ছিদ্র সহজে বন্ধ হয় না।ফলে অনেকটা রক্ত পরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।এবং কোন প্রানীকে যদি অনেক বেশি জোঁকে রক্ত খায়, তবে প্রানিটি রক্ত শূন্যতায় ভুগতে পারে।এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ধারণা করা হয়, অনেক আগে কয়লার মাধ্যমে এই জোঁক বাংলাদেশে এসেছে।
প্রাচীনকাল থেকে রক্তচোষা জোঁক দিয়ে রক্ত জমাট বাঁধা (blood cloting) বন্ধ করার জন্য চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়েছে। তঞ্চন বন্ধ করার জন্য জোঁকের লালায় হিরুডিন নামক রক্ত জমাট রোধক(anticoagulant) পেপটাইড ক্ষরিত হয়।যার কারনে রক্ত জমাট বাধে না।
১। জোঁকের দেহ গঠন কেমন?
এই রক্তচোষা জোঁকের দেহের গঠন খুবই বৈচিত্রময় ও অবিস্যাস্য।জোঁকের রয়েছে ৩২ টি ব্রেইন।অর্থাৎ একটি ব্রেইনের মোট অংশ ৩২ টি গ্যাংলিয়া দ্বারা তৈরি। যা এক খন্ড হওয়া সত্বেও ৩২ টি ব্রেইনের সমান কাজ করে ।এদের তিনটি মুখ থাকে, অর্থাৎ তিন জোড়া চোয়াল । প্রতিজোড়া চোয়ালে ১০০ থেকে ৩০০ টি পর্যন্ত দাঁত থাকে । এদের পাঁচ জোড়া বা ১০ টি চোখ থাকে । এরকম আশ্চর্য গঠনের শরীর নিয়ে এরা ঘুরে বেড়ায় ডাঙ্গায় কিংবা পানিতে শুধু রক্তের খোঁজে ।
২। জোঁক কামড়ালে কি হয়?
জোঁকের কামরে কোন ক্ষতি হয় না।তবে বেশি কামরালে রক্ত পরা সহজে বন্ধ হয় না বলে রক্ত সল্পতা দেখা দিতে পারে।তাছাড়া তেমন কোন ক্ষতি হয়না।তবে জোঁক কামরালে কিছু উপকার হয়।
৩। জোঁকের কামড়ের উপকারীতা কি?
জোঁকের কামড়ে ক্ষতির চেয়ে উপকার বেশি।গবেষনায় দেখা গেছে , একটি জোঁক ২-১৫ মিলিলিটার রক্ত শুষতে পারে।এবং রক্ত শুষার সময় জোঁকের মুখ থেকে এক ধরনের লালা রক্তে মিশে যায়। যাতে হিরুডিন, ক্যালিক্রেইন, ক্যালিনের মতো কিছু উৎসেচক উপাদান থাকে।এই উৎসেচক রক্তের দূষণ দূর করতে সাহায্য করে।
জোঁক প্রানীর শরীরের পচনশীল অংশের দূষিত রক্ত দ্রুত শুষে নিতে পারে।যার ফলে নতুন রক্ত সঞ্চালনে সাহায্য হয়৷এছাড়া রক্তে শর্করার মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে রাখতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে। জোঁকের শরীর থেকে ডেস্টাবিলেস নামে এক ধরণের প্রোটিন প্রানির দেহে প্রবেশ করে। যা বহু জীবাণুকে মেরে ফেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।"জয়েন্ট পেইন"(মারাত্বক ব্যাথা) নিবারনেও দারুণ কাজ করে জোঁক থেরাপি। ব্যথার জায়গায় জোঁক দ্বারা কামড়ানো হলে, সেখানকার দূষিত রক্ত ও পচা উৎসেচক জোঁক শুষে নেয়।এবং জোঁক থেকে কিছু উৎসেচক সেখানে প্রবেশ করার কারনে সেখানের জীবানু ধংস হয়।ফলে ব্যাথা কমে যায়।
৪। জোঁক দ্বারা তৈরি ঔষধ বা জোঁক থেরাপি
বিভিন্ন থেরাপি চিকিৎসায় জোঁকের ব্যবহার হয়ে আসছে আদিকাল থেকেই। ইংল্যান্ডে রানী ভিক্টোরিয়ার যুগে প্রতি বছর প্রায় চার কোটি বিশ লাখ জোঁকের ব্যবহার হতো চিকিৎসা খাতে।এই সকল জোঁকের যোগান দিত "ওয়েলস" নামক একটি প্রতিষ্ঠান । প্রতিষ্ঠানটির প্রতি বছরে আয় হতো প্রায় দশ লাখ পাউন্ড শুধু এই জোঁক সরবরাহ করে । তখন কৃষির মত জোঁক চাষ করা হতো।
কিন্তু গত ১৯ শতকে চিকিৎসা ক্ষেত্রে জোঁকের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠায় এর ব্যবহার অনেক কমে গিয়েছিল। এখন ২০ শতকে আবার জোঁক নিয়ে গবেষণা করে এর বহুবিধ উপকার প্রমাণিত হয়েছে।ফলে আবার চিকিৎসা বিজ্ঞান জোঁকের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে ।এজন্য জোঁকের ব্যবহার অনেক বেড়ে গিয়েছে। এখন ইংল্যান্ড জোঁক চাষ করে নিজেদের প্রয়োজন মেটায় ও ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে সরবরাহ করে । ইংল্যান্ডেই এখন প্রতি বছর প্রায় ষাট হাজার জোঁক লাগে ।এই জোঁক সরবরাহের এক নম্বর প্রতিষ্ঠান হল "সোয়ানসি'জ বায়োফার্ম" ।
জোঁক নামের ঘৃণ্যীয় প্রাণীটির দ্বারা থেরাপি চিকিৎসায় অনন্য ভূমিকা রয়েছে। জোঁক দ্বারা তৈরি ঔষধ , হৃদযন্ত্রে রক্তজমাট, পেশীসংকোচন, বাত ব্যাথা, শরীর ব্যথা ,কাটাস্হান জোড়া লাগানো সহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
কোনো ব্যাথা বা আক্রান্ত স্থানে জোঁকের কামড় বসালে তাদের মুখের লালার সাথে এক বিশেষ পদার্থ মানুষের রক্তের সাথে মিশে যায়।যার ফলে জমাট বাঁধা রক্তের সাথে মিশে তার গাঢ়ত্ব কমিয়ে দিয়ে পাতলা করে স্বাভাবিক চলাচলের সহায়তা করে । ঘৃণা ভরে আমরা এদের দুরে সরালেও এরা আমাদের কল্যাণেই নিবেদিত । সৃষ্টি কর্তার সমস্ত সৃষ্টিই মানব কল্যানে নিবেদিত , শুধু মানুষের উপকারেই তারা কাজ করে।কিন্তু আমরা অনেকই তা বুঝতে পারি না বা বোজলেও বিরক্ত হই।।
৫। জোঁকের কামর থেকে বাচার উপায়?
যেহেতু অধিক জোঁকের কামড়ে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই অধিক জোঁক রয়েছে এমন জায়গায় যেতে হলে কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করা যেতে পারে।
যেসব স্থানে জোকের আক্রমণ বেশি করতে পারে, সেসব স্থান বিশেষ করে পায়ে কেরোসিন তেল বা সরিষার তেল মেখে নিলে জোঁক আর ধরতে পারবে না।এছাড়া জোঁকের শত্রু লবন ।তাই তেলের সাথে লবন দিলে আরো ভালো।
৬। জোঁক সরীর থেকে ছাড়ানোর সঠিক উপায় কি?
সরীরে জোঁক ধরলে তা সহজে ছাড়ানো যায় না।শক্ত করে টেনে ছাড়ালে যেখানে কাম দিয়েছিল সেখানে বড় ক্ষত হতে পারে এবং সহজে রক্ত বন্ধ নাও হতে পারে।এতে অনেক ধরনের সমস্যা সৃস্টি হতে পারে।
আবার লবন বা সিগারেটের ছ্যাকা বা সাবান অথবা লেবুর রস ইত্যাদি দিয়ে ছাড়ালে , কামড় দেওয়া অবস্থাতেই জোঁকটি ভমি করে দিতে পারে।যার ফলে সেই পচা রক্ত ও বিভিন্ন ক্ষতিকর উৎসেচক সরীরে প্রবেশ করবে।আর সেই ক্ষতস্থানে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ হতে পারে।
তাই সবচেয়ে উত্তম জোঁকটি একাই রক্ত ক্ষেয়ে পরে যাওয়া।কিন্তু সরীরে জোঁক খুজে পাওয়ার পর সেটা সরীরে রেখে দেওয়ার মত লোক পাওয়া যাবে না।সেটা সমভবও না।তাই আপনারা যা করতে পারেন তা হলো, হালকা লবনের পানি দ্বারা হাত ভিজিয়ে অথবা হাতে থুথু লাগিয়ে জোঁকের মাথায় চাপ দিয়ে টেনে ছাড়িয়ে ফেলুন।এছাড়া একই ভাবে গাছের পাতা বা কাগজ বা পলিথিন দিয়ে ছাড়াতে পারেন।